ইউরোপের নাগরিকত্ব পাওয়া অনেকেরই আজীবনের স্বপ্ন। কারণ ইউরোপের একটি দেশের নাগরিকত্ব থাকলেই শেনজেন এরিয়া ভুক্ত ২৭টি দেশে বিনা ভিসায় ভ্রমণ করা যায়। উন্নত জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের কারণে ইউরোপ প্রবাসীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য। তবে ইউরোপের প্রতিটি দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার নিয়ম আলাদা। আজকের এই ব্লগে জেনে নিন ইউরোপের কোন কোন দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ, তাদের নাগরিকত্বের শর্ত ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত।

ইউরোপে নাগরিকত্ব পাওয়ার নিয়ম
ইউরোপীয় দেশগুলো সাধারণত চারটি প্রধান পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব প্রদান করে থাকে –
1️⃣ জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব (Citizenship by Birth)
2️⃣ বংশসূত্রে নাগরিকত্ব (Citizenship by Descent)
3️⃣ বিবাহসূত্রে নাগরিকত্ব (Citizenship by Marriage)
4️⃣ প্রাকৃতিকীকরণ বা ন্যাচারালাইজেশন (Naturalization)
তবে প্রত্যেক দেশের সময়কাল, ভাষা দক্ষতা, আর্থিক সামর্থ্য, এবং আইনি শর্তে ভিন্নতা থাকে। নিচে এমন পাঁচটি ইউরোপিয়ান দেশের নাম উল্লেখ করা হলো যেখানে নাগরিকত্ব পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ এবং প্রবাসীদের জন্য সুযোগ বেশি।
আয়ারল্যান্ডে নাগরিকত্ব (Ireland Citizenship)
আয়ারল্যান্ড পশ্চিম ইউরোপের একটি সমৃদ্ধ দেশ এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার দিক থেকে এটি অন্যতম সহজ ইউরোপীয় দেশ। আয়ারল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাওয়া যায় জন্মসূত্রে, বংশসূত্রে, বিবাহসূত্রে অথবা ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে। যদি কেউ অন্তত পাঁচ বছর আয়ারল্যান্ডে বৈধভাবে বসবাস করেন, তবে তিনি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন।
রাজধানী: ডাবলিন (Dublin)
ভাষা: ইংরেজি ও গায়েলিক
মুদ্রা: ইউরো (EUR)
সরকারব্যবস্থা: পার্লামেন্টারি রিপাবলিক
আয়ারল্যান্ডের বিশেষত্ব হলো—এই দেশের পাসপোর্ট খুবই শক্তিশালী এবং এটি দিয়ে ১৮০টিরও বেশি দেশে ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করা যায়।
পর্তুগালে নাগরিকত্ব (Portugal Citizenship)
পর্তুগাল দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের একটি জনপ্রিয় দেশ, যেখানকার “Golden Visa Program” নাগরিকত্বের জন্য সবচেয়ে আলোচিত। আপনি যদি পর্তুগালে বৈধভাবে অন্তত ৫ বছর বসবাস করেন, অথবা কোনো পর্তুগিজ নাগরিককে বিয়ে করেন, তাহলে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়।
রাজধানী: লিসবন (Lisbon)
ভাষা: পর্তুগিজ (Portuguese)
জনসংখ্যা: প্রায় ১০ মিলিয়ন
মুদ্রা: ইউরো (EUR)
পর্তুগালে নাগরিকত্ব পাওয়ার আরেকটি সুবিধা হলো—এখানে বিদেশিদের জন্য ট্যাক্স সুবিধা ও রেসিডেন্স পারমিট প্রোগ্রাম খুব সহজ। এজন্য অনেক বাংলাদেশি প্রবাসীও এই দেশটি বেছে নিচ্ছেন।
জার্মানিতে নাগরিকত্ব (Germany Citizenship)
জার্মানি ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর একটি। নাগরিকত্ব পেতে হলে জার্মানিতে অন্তত ৮ বছর বৈধভাবে বসবাস করতে হয়। তবে যদি কেউ জার্মান ভাষায় দক্ষ হন এবং সামাজিকভাবে একীভূত হন, তাহলে সময়কাল ৬ বছরে নামিয়ে আনা হয়।
রাজধানী: বার্লিন (Berlin)
সরকারব্যবস্থা: ফেডারেল পার্লামেন্টারি রিপাবলিক
ভাষা: জার্মান (German)
মুদ্রা: ইউরো (EUR)
জার্মান নাগরিকত্বের আরেকটি পথ হলো “Citizenship by Descent” — যদি আপনার পূর্বপুরুষ জার্মান হন, তবে প্রমাণসাপেক্ষে আপনি নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন।
ইতালিতে নাগরিকত্ব (Italy Citizenship)
ইতালি ইউরোপের একটি ঐতিহাসিক দেশ, যেখানে বংশসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া সবচেয়ে সহজ। ইতালির “Jure Sanguinis” আইনে বলা আছে—যদি আপনার পূর্বপুরুষ ইতালিয়ান হন, তাহলে আপনি প্রজন্ম নির্বিশেষে নাগরিকত্বের যোগ্য হতে পারেন।
রাজধানী: রোম (Rome)
ভাষা: ইতালিয়ান (Italian)
জনসংখ্যা: প্রায় ৬০ মিলিয়ন
মুদ্রা: ইউরো (EUR)
তাছাড়া, ইতালিতে বৈধভাবে ১০ বছর বসবাস করলে ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। বিবাহসূত্রেও ২-৩ বছরের মধ্যে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা সম্ভব।
স্পেনে নাগরিকত্ব (Spain Citizenship)
স্পেনে নাগরিকত্ব পেতে সাধারণত ১০ বছরের বৈধ বসবাসের প্রয়োজন হয়। তবে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য এই সময়কাল মাত্র ২ বছর। বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে ন্যাচারালাইজেশন প্রক্রিয়া ১০ বছর।
রাজধানী: মাদ্রিদ (Madrid)
সরকারব্যবস্থা: সংসদীয় রাজতন্ত্র
ভাষা: স্প্যানিশ (Spanish)
মুদ্রা: ইউরো (EUR)
স্পেনের নাগরিকত্বের সুবিধা হলো—একবার নাগরিকত্ব পেলে আপনি শেনজেন জোনের সব দেশে কাজ ও বসবাসের অনুমতি পাবেন।
ইউরোপে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে যা জানা জরুরি
ইউরোপের প্রতিটি দেশের নিজস্ব নাগরিকত্ব নীতিমালা আছে। সাধারণত ভাষা দক্ষতা, আর্থিক স্থিতি, সামাজিক একীকরণ এবং অপরাধমুক্ত রেকর্ড নাগরিকত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রমাণপত্র জমা দেওয়া, সাক্ষাৎকার ও শপথগ্রহণ প্রক্রিয়াও অনেক দেশে বাধ্যতামূলক।
FAQ – ইউরোপের নাগরিকত্ব সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন
ইউরোপে কোন দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া সবচেয়ে সহজ?
বর্তমানে পর্তুগাল ও আয়ারল্যান্ডে নাগরিকত্ব পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ।
Golden Visa কী?
Golden Visa হলো এমন একটি প্রোগ্রাম যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে রেসিডেন্স পারমিট বা নাগরিকত্ব পেতে পারেন।
ইউরোপের নাগরিকত্ব পেতে কত বছর লাগতে পারে?
দেশভেদে সময় ভিন্ন হয়, সাধারণত ৫ থেকে ১০ বছর বৈধভাবে বসবাস করতে হয়।
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য কোন দেশ সবচেয়ে উপযোগী?
বাংলাদেশিদের জন্য পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড এবং ইতালি নাগরিকত্ব পাওয়ার দিক থেকে তুলনামূলকভাবে সহজ ও বাস্তবসম্মত।
ইউরোপের নাগরিকত্ব কি একাধিক দেশে রাখা যায়?
অনেক ইউরোপীয় দেশ ডুয়েল সিটিজেনশিপ অনুমোদন করে, যেমন আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল ও ইতালি। তবে কিছু দেশ একাধিক নাগরিকত্ব অনুমতি দেয় না।
এই ছিল ইউরোপের কোন দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ। আপনি যদি বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা করেন, তাহলে প্রতিটি দেশের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে আপডেট তথ্য সংগ্রহ করুন এবং প্রয়োজনে একজন ইমিগ্রেশন আইনজীবীর পরামর্শ নিন। ধৈর্য ধরে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে ইউরোপের নাগরিকত্ব অর্জন আর কঠিন নয়।
Leave a Reply